চট্টগ্রামে সাম্পানকে উপজীব্য করে সমৃদ্ধ হত অর্থনীতি। সঙ্গে উৎকর্ষতা লাভ করেছে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেও। রচিত হত নানা রূপকথার গল্প, নাটক ও গান। সঙ্গে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে বর্ণিল সাম্পান।
এক যুগ আগেও কর্ণফুলী, সাঙ্গুনদী ও বাঁশখালীর জলকদর খালে সাম্পান চলাচল করতো কমপক্ষে দুই হাজার মতো। হাজার বছরের ঐতিহ্য চট্টগ্রামের সাম্পান চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আঙিনার প্রোজ্জল এবং দেদীপ্যমান একটি নাম। সাম্পান কর্ণফুলী নদীর হাজার বছরের ঐতিহ্যও বটে।
তদুপরি ‘চট্টগ্রাম’ নিজেও নানা অভিধা-বিশেষণে বিশেষায়িত। এর মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্য-স্মারক হিসাবে স্বীকৃত চাটগাঁর ‘সাম্পান’। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সাম্পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লোগোতে ধারণ করে চট্টগ্রামে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনুপম স্মারক হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
চট্টগ্রাম নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- ‘সাম্পান,শুঁটকি, দরগা-এ নিয়ে চাটগাঁ’। এটির সঙ্গে চট্টগ্রামের বাসিন্দার জীবন-জীবিকার সম্পর্কও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলো। প্রচলন আছে যে, কর্ণফুলী নদীতে একসময় যাত্রীবাহী জাহাজ ও স্টিমার চলাচল করতো। জাহাজ থেকে নেমে যাত্রীরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে কূলে ওঠার জন্য সাম্পানের যাত্রা শুরু। এটি পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
কর্ণফুলী নদী ঐতিহ্য প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম জানান, কর্ণফুলী নদীর তীরে বর্তমান যে বিবর্ণ অবস্থা তা অতীতে ছিল না। অতীতে চট্টগ্রাম বন্দরে নির্মিত জাহাজ রপ্তানি হতো সারা বিশ্বে। সাম্পান ইতিহাস থেকে জানা যায়, সপ্তদশ শতকে তুরস্কের শাসক সুলতান ও অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান সুলেমানদের নৌ বহরের অধিকাংশ জাহাজ নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
একবার এক আদেশে সুলতান চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৩টি জাহাজ ক্রয় করেছিলেন। বৃটিশ নৌ বহরেও চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজের প্রাধান্য ছিল। ১৯২৪ সালে কলকাতা বন্দরে ১১টি বৃটিশ জাহাজের মধ্যে ৮টিই ছিল চট্টগ্রামের তৈরি। ১৯০০ শতকে চট্টগ্রামে এক হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ তৈরি হতো।
কর্ণফুলী নদীতে কি পরিমাণ সাম্পান চলাচল করে তার কোন পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে সাম্পানের মাঝি তোরাব আলী মাঝির সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক যুগ আগেও এ নদীতে সাম্পান চলাচল করতো কমপক্ষে দুই হাজার, বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা, সাঙ্গুনদী হয়ে জলকদর খালে দিয়ে কর্ণফুলীতে আসতো সাম্পান চট্টগ্রামে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে হয়েছে কয়েকশ’।
গবেষক আলীউর রহমান তিনি লিখেছেন, কর্ণফুলীর সাম্পান চট্টগ্রামের আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করে। নদীর দু’ধারে নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে মানুষের মধ্যে নদী নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে এ নদীর ঐতিহ্য সাম্পান এখন হারিয়ে গেছে। এতে অনেকে মাঝি পেশা পরিবর্তনও করেছে।
সিজার ফ্রেডারিক লিখেছেন প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে ২৫ থেকে ৩০টি জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। চট্টগ্রামের তৈরি জাহাজ আলেকজেন্দ্রিয়ায় তৈরি জাহাজের চেয়ে উন্নত ছিল। জার্মানির ব্রেমার হ্যাভেন জাদুঘরে এখনও চট্টগ্রামের তৈরি জাহাজ ও সাম্পান প্রদর্শনীর জন্য রক্ষিত আছে। এই ক্ষুদ্র সাম্পান ও রণতরীটি ১৯১৮ সালে নির্মিত হয়েছিল।
মন্তব্য করুন