জাতীয় পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বাস্তবায়নের জন্য ২০২০ সালে কমিটি গঠন করে তৎকালীন সরকার। এ কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ আমলা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। এ কমিটিকে সহায়তা করতে ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি দায়িত্ব প্রদান করা হয় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ানকে। কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ছাত্রহত্যা মামলায় কারাগারে থাকলেও এমদাদ উল্লাহ মিয়ান এখন আছে একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে। অথচ মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল, স্মারক ও স্থাপনা নির্মাণকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা এবং দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে।
ড. মিয়ান ছিলেন প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের নাম নেই, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বরং তিনি বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয়ে তিনি একই ধরনের দলীয় পক্ষপাত ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থে পরিচালিত নীতি অনুসরণ করছেন। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। এই তদন্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা এবং তৎকালীন মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর নাম এসেছে। কামাল আবদুল নাসের বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
মাঠপর্যায়ে প্রকল্প অনুমোদন, বরাদ্দ, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও তিনি এখনো দায়মুক্ত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট কি তাকে দায়মুক্ত করেছে—সে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। বর্তমানে কৃষি সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকা এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের বিরুদ্ধে কৃষি প্রশাসনে দলীয় পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন ও নিয়োগে তার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এর সময় আওয়ামী সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যেসব আমলা বিবৃতি ও সভা-সমাবেশে অংশ নেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে পুনর্বাসিত হন। তাদের কেউ সরাসরি না হলেও এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের ছত্রচ্ছায়ায় পুনর্বাসিত হয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদায়নে এই প্রভাব স্পষ্ট।
তারই পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল ইসলাম, পরিচালক (অর্থ) হাবিবুল্লাহ, সরেজমিন উইং পরিচালক ওয়বায়দুর রহমান মণ্ডল, হর্টিকালচার উইং পরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দীন, সাবেক ডিজি হামিদুর রহমানসহ একাধিক বিতর্কিত কর্মকর্তা এখনো বহাল আছেন।
মুজিববর্ষে স্থানীয় পর্যায়ে একটি ম্যুরাল নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা, যা বাস্তবে ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক স্থানে একই প্রকল্পের নামে একাধিকবার বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। আবার কেন্দ্র থেকে নির্ধারিত উৎস থেকে মালামাল কেনার শর্ত আরোপে স্থানীয় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সিন্ডিকেটভিত্তিক কেনাকাটার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যয়ের কাঠামোই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করেছে। তাঁদের ভাষায়, “উন্নয়ন নয়, বরং রাজনৈতিক চেতনার প্রচারই ছিল মুখ্য লক্ষ্য।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলোর ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় প্রকল্প পার্টনারের গড় অগ্রগতি মন্ত্রণালয়ের গড় অগ্রগতির চেয়ে অনেক কম। কারণ, প্রকল্পটির সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান সঠিকভাবে কাজ না করলেও তাকে বহাল রাখা হয়েছিল। পরে তার বিরুদ্ধে ছুটির দিনে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটেও (ব্রি) একই চিত্র। বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত ড. মো. খালেকুজ্জামান ‘রুটিন দায়িত্বে’ মহাপরিচালক পদে বহাল আছেন। অথচ প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প বাস্তবায়ন গড়ের তুলনায় অনেক কম।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিনা) ‘রুটিন দায়িত্বে’ মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ড. মো. আবুল কালাম আজাদ। তার অপসারণের দাবিতে ১৮ মার্চ বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা মানববন্ধন করে এবং তার কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। অচলাবস্থা এখনো চলমান। একই ধরনের সংকট বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটেও। আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা ড. নার্গিস আক্তারকে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চারজন যোগ্য কর্মকর্তাকে উপেক্ষা করে। এ নিয়েও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটে ড. সালাহউদ্দিন আহমেদকে রুটিন দায়িত্বে মহাপরিচালক করা হয়েছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা ড. আবদুল হাকিমকে, যদিও তৃতীয় গ্রেডের যোগ্য কর্মকর্তা সেখানে আছেন। এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সম্প্রতি বিএনপি ঘেষা হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রশীদকে বদলি করায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে (ডিএই) দুই দিনব্যাপী মানববন্ধন হয়। পরে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের দ্বারস্থ হন।
ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একাধিক মানববন্ধন হয়েছে। সর্বশেষ ১৬ ফেব্রুয়ারি তাকে ‘ফ্যাসিস্ট আমলা’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কৃষি) অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ড. মো. সাহিনুল ইসলাম দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে সদস্যদের স্বাক্ষরিত আবেদন জমা দেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ফ্যাসিস্টদের দোসরকে রেখে মন্ত্রণালয়ের ভিশন ও মিশন অর্জন এবং দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়।’ তার অপসারণ চেয়ে একই দাবিনামা কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছেও পাঠানো হয়েছে।
মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গঠিত তিন সদস্যের বিশেষ কমিটিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই এমদাদ উল্লাহ মিয়ান ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রশাসনের অংশ হয়ে ওঠেন। দুর্নীতির দায়ে যখন মুখ্য সচিব পর্যন্ত জবাবদিহির আওতায় আসেন, তখন অতিরিক্ত সচিব থাকা অবস্থায় এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের দায়মুক্তি শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, প্রশাসনে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধাও।
বিতর্কিত এই সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান প্রশাসন ক্যাডারের ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন তৎকালীন মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, যিনি দুর্নীতির মামলায় বর্তমানে কারাবন্দি।
এর আগে তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন। পরে তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান এবং একই দিন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার কর্মপরিধিতে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং আইএমইডির মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন।
মন্তব্য করুন